তিতাসের ঐতিহ্য (নৌকা বাইচ ২০২২)
পৃথিবীর প্রতিটি দেশের, প্রতিটি অঞ্চলের কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে রয়েছে বৈচিত্র্যতা, রয়েছে অনন্য সৌন্দর্য যা শুধুমাত্র ঐ নির্দিষ্ট অঞ্চলের লোকেরাই পারে উৎকৃষ্টরূপে উপভোগ করতে। আবার নিজস্ব ঐতিহ্যগুলোকে প্রতিটি জাতি সাদরে গ্রহণ করতে কখনো পিছপা হয় না। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে যখন আপনি অন্য কোনো একটি দেশের ঐতিহ্যকে ক্ষণিকের জন্য অবলোকন করবেন, সেটি আপনার জন্য বেমানান হতে পারে, আপনি তাতে তৃপ্ত না হয়ে, অট্ট হাসি হেসেও দিতে পারেন কারন সে দেশের ঐতিহ্যবাহী কোনো একটি জিনিস আপনার কাছে অদ্ভুত লেগেছে আর সেটা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয় যা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়।
আর এটা যে একমাত্র আপনার ক্ষেত্রেই ঘটে এমনটা নয়, এটা স্বতন্ত্র, সব দেশের সব মানুষের সাথে এমনটাই ঘটে। আর হ্যাঁ, আপনার কাছে যে অন্যের যে ঐতিহ্যটি ব্যতিক্রমধর্মী বলে মনে হয়, সেটিই কি আপনাকে সে দেশের বা সে অঞ্চল সম্পর্কে ধারণাটি বহুদিন মনের মধ্যে পুষে রাখতে সহায়তা করে না? একজন ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একজন ব্যাক্তি তার বৈশিষ্ট্যের জন্য আপনার মনে স্থান করে নেয়। ঠিক তেমনি, একটি এলাকার স্বতন্ত্র ঐতিহ্য, সে এলাকার নাম বহুদিন নির্দ্বিধায় মনে মধ্যে গেঁছে রাখতে সহায়তা করে।
যখনই কোনো অঞ্চলের বিখ্যাত জিনিসের কথা আমরা শুনি, আমাদের মস্তিষ্ক সে অঞ্চলের দিকে টেনে নিয়ে যায়, সে অঞ্চলের নাম একবারের জন্য হলেও স্মরণ করতে আমাদের বাধ্য করে। যেমন বাংলাদেশের একেক অঞ্চলের খাবারের কথাই ধরা যাক না কেনো; আমের কথা শুনলে আমাদের রাজশাহীর কথা মাথায় চলে আসে, চাঁপুরের ইলিশ, কুমিল্লার রসমালাই প্রভৃতি। প্রতিটি দেশের মাতৃভাষা তাদের দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতির একটি অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি দেশের নাগরিকই তাদের দেশের ভাষা, সংস্কৃতিকে স্বযত্নে লালান করে। কিন্তু একমাত্র আমি বাঙালিদেরকেই দেখলাম যারা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে নিজস্ব ঐতিহ্যকে দূরে সরিয়ে, অন্যের ঐতিহ্যকে ধার করে বা জোরপূর্বক নিজের বানিয়ে নিজেকে দাম্ভিকভাবে আধুনিক বলে জাহির করার বৃথা চেষ্টায় মগ্ন।
এদুর্দিনের মধ্যে বাঙালি তাদের নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য আজও বাঁচিয়ে রাখার দরুন, বিরাট প্রশংসার দাবিদার বটে। গতকাল থেকে পুরো শহরে কম বেশি প্রতিটি মানুষের কৌতূহল আর আগ্রহের ছাপ দেখতে পেলাম নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে। প্রথমত আমার স্টুডেন্টই জিজ্ঞাসা করে বসল নৌকা বাইচ দেখতে যাবো কি না। অবশ্য আমার ছোটকাল থেকেই তিতাসের এই ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ দেখার ভীষণ শখ ছিল। কিন্তু কখনোই তেমন যাওয়া হয়নি, কারন প্রায়সই বৃষ্টি পড়ত সেসময় অথবা বাবা বারণ করে যেতেন, একা একা যেতে।
সে যাইহোক প্রায় দুবছর পর করোনার পর, তিতাসে নতুনরূপে তার পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার দরুন তিতাস পাড়ের বাসিন্দারা খুবই উচ্ছ্বসিত। আমি বোধ হয় ভুল শুনলাম যে নৌকা বাইচ দুপুর এক ঘটিকা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে, আমার বোধহয় আরেকটু পরে গেলেই ভালো হবে। তাই দুপুর ২ টার পর বাসা থেকে বের হয়ে তিতাসের নৌকা বাইচের সূচনা স্থান শিমরাইল কান্দি, তিতাসের পাড়ে দিকে যেতে লাগলাম।
সেথায় গিয়ে আমি বেশ খুশিই হলাম, কারন আমি পথিমধ্যে ভাবতেছিলাম আমার বোধহয় ভীষণ দেরিই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু না তখন সারি সারি বিভিন্ন রঙের নৌকা পাড়ে ভীড়তে ছিলো, প্রতিযোগিতা শুরু হবার উপক্রম। সে যাইহোক আমি এক পাশে দাড়িঁয়ে তিতাসে সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে রইলাম। পাশ থেকে কে যেন আমার নাম ধরে ডাক দিয়ে বলল জেরিনকে একটু উপরে তুলে ধরতে। আমি পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম আমার স্টুডেন্টের মা সবাইকে একসাথে নিয়ে এসেছে নৌকা বাইচ উপভোগ করতে। এদিকে প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার উপক্রম, আর জেরিন (আমার স্টুডেন্টের ছোট বোন) এমনিতে আমার সাথে ভালোই মিশুক কিন্তু সেসময় কেন যেন কোনো কথা বলতে ছিলো না। হয়তো বহু মানুষের সমাগম দেখে কিছুটা বিচলিত সে। আমি আর কাছে না ডেকে কিছুক্ষণ তাদের পাশে দাড়িঁয়েই প্রতিযোগিতা উপভোগ করতে থাকি।
রঙবেরঙের নৌকাগুলোর মাঝে মাঝিদের উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য, গ্রামীণ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আর ভাওয়াইয়া গানের তালে তালে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী নৌকাগুলো এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় সর্বমোট ১৩ টি নৌকা, আর যার মধ্যে ৬টি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ও হবিগঞ্জ উপজেলার আর বাকি একটি আশুগঞ্জের। তিনটি নৌকার মধ্যে প্রতিযোগিতা মধ্যে একটি করে বিজয়ী নৌকা নিয়ে, চারটি নৌকার মাঝে ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। আর শেষের দৃশ্যটি দেখা মতো ছিল, ফাইনাল রাউন্ডের চারটি নৌকার পিছু পিছু অসংখ্য ছোট ছোট নৌকা যেতে থাকে আসল বিজয়ীর সন্ধানে এবং তিতাস ফিরে পায় তার জীবন্ত ব্যস্ত আপন রূপ।
এদিকে আবার জনমানুষের উপস্থিতিতে আমাকে ভাবতে বাধ্য করল যে, নিজ দেশের ঐতিহ্যের প্রতি টান এখনো মানুষের প্রাণের মধ্যে বহমান। যাক, দিন শেষে এটি হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তির জায়গা। যতদিন এ ধরনের ঐতিহ্যগুলো চলমান থাকবে আর তা দেখতে আসা বাঙালীর ভীড়ই প্রমাণ করবে এ দেশের অস্তিত্ব, ঐতিহ্য বাঙালী আজও তাদের প্রাণে লালন করে।
এই নৌকা বাইচ সম্পর্কে অনকে শুনেছি কিন্তু কখনো সামনাসামনি দেখা হয়ে উঠেনি 😩। দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভালোই ইনজয় করেছেন 🙂।
এই তিতাস কি হোমনার তিতাস? মানে তিতাস উপজেলা?
জ্বি, ভাই। দিনটি ভীষণ উপভোগ্য ছিল আমার জন্য, কারন সচরাচর প্রতিবার এসময় আকাশটা মেঘলা থাকে, কখনো বা ভারী বর্ষণ শুরু হয়। কিন্তু এবারের দিনটি বলতে গেলে একদমই পারফেক্ট একটি দিন ছিল, কারন আকাশটা ভীষণ সুন্দর ছিল, আমি যখন সেখানে যাই এত ভীড় ছিল না। কিন্তু ক্ষণিকের মধ্যে আমি লক্ষ্য করলাম তিতাসের পাড় কানায় কানায় জনমানুষে পরিপূর্ণ।
আর হ্যা, ভাই এটা সদর, আর এখানেই প্রতি বছর ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচের অনুষ্ঠিত হয়।
নৌকাবাইচগুলো খুব চমকপ্রদ বিনোদন দেই, এটি আমাদের সত্যিই এক মনোমুগ্ধকর ঐতিহ্যের সাক্ষী, নদীবিধৌত অঞ্চলে মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল মাছ ধরা, নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার, তাদের গলায় কত নদীর টানে সুর করা গান ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, এখনো সংস্কৃতির এক অপূর্ব দিক হয়ে আছে।
দিনটি সত্যিই ভালো ছিল, তিতাস নদী, খুব সুন্দর দেখতে 👍।।
হ্যাঁ, ভাই। তাদের ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি গান মনের মধ্যে অজান্তেই জোস তুলতে বাধ্য। এক এক করে বিচিত্র রঙের নৌকাগুলো জড়ো হচ্ছিল, প্রতিটি নৌকায় দুজন করে লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, হাতে করতাল নিয়ে বাইঠার তালে তালে তা বাজিয়ে মাঝিদের উৎসাহ দিচ্ছিলো সামনের পানে যাওয়ার।
আর প্রতিটি নৌকায় ৬০ জন করে মাঝি, সে তালে তালে এগিয়ে যাচ্ছিলো সামনের দিকে। আর এই প্রথম তাদের গলা ছেড়ে গান গাওয়ার দৃশ্য আমি নদীর পাড় থেকে অনুভব করলাম যা সত্যই মনোমুগ্ধকর ছিল আমার কাছে। আর সমমিলিয়ে দিনটাও চমৎকার, প্রথমবার নৌকা বাইচ দেখার স্মৃতি হিসেবে মনে রাখার মতোই একটি দিন কাটিয়েছিলাম।