কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙে রাঙা এক দিন...
"কৃষ্ণচূড়া লাল হয়েছে ফুলে ফুলে, তুমি আসবে বলে।" বাংলা গল্প, উপন্যাস, গান কিংবা কবিতায় কৃষ্ণচূড়ার উপস্থিতি অনেক বেশি৷ প্রেম, ভালবাসা কিংবা বিরহের ক্ষেত্রেও কৃষ্ণচূড়াকে উপমা হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। এই গাছের নামকরনের পেছনের গল্প আমি জানি না। তবে নামটা সুন্দর। এজন্যই হয়তো উপমায় কৃষ্ণচূড়া নামটা বেশি ব্যাবহৃত হয়।
ভিক্টোরিয়া কলেজের ভেতর এই কৃষ্ণচূড়া গাছটি বাইরে দিয়ে আসা যাওয়া করার সময় কমবেশি সবারই চোখে পড়ে। এপ্রিলের পরে, অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে এই গাছে ফুল ধরে৷ কিন্তু এখন তো সেপ্টেম্বর, কিছু ফুল এখনোও টিকে আছে। কারণ আর কিছুদিন পরেই শীতকাল। পুরো গাছের পাতা ঝড়ে যাবে৷ এরপর বসন্ত আসতে আসতে আসতেই আবার নতুন করে নিজেকে সাজিয়ে নিবে গাছটি৷
খুব ভোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার উদ্দেশ্যে স্টেশনে যাওয়ার সময় চোখ পড়েছিল। ভোর রাতের বৃষ্টির পর সতেজ পরিবেশে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল গাছটিকে। গাছের নিচে বসার স্থান আছে। ইচ্ছে হচ্ছিল কিছুক্ষণ গিয়ে বসে থাকি। কিন্তু সেই সুযোগ তো নেই৷ ট্রেইন আসতে আর কিছুক্ষণ বাকি৷ ইচ্ছেটা অপূর্ণ রেখেই স্টেশনের দিকে চলে গেলাম।
তবে স্টেশনে গিয়ে নতুন একটা জিনিস চোখে পড়ল। স্টেশনের তৃতীয় রেল লাইনে ছোটখাটো সাইজের একটা ট্রেইন দাঁড়িয়ে ছিল। সাধারণত কুমিল্লা রেল স্টেশনে এই সময়ে এই লাইনে অন্য কোনো ট্রেইন দাঁড়ায় না। আবার এই সময়ের শিডিউলে অন্য কোনো ট্রেইনও নেই। একটু কাছে গিয়ে বুঝা গেল এটা আসলে কোনো যাত্রীবাহী ট্রেইন না। ভ্রাম্যমান মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর। ট্রেইনের গায়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা ধরনের আর্ট। দেখতে খারাপ লাগছিল না। তবুও মনে মনে ভাবছিলাম, এধরনের ভ্রাম্যমান জাদুঘর বানিয়ে আসলে লাভটা কী? কেউ তো ভেতরে ঢুকতেও পারছে না। লক করা। বিকেলে যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে আসি, ঠিক তখনোও এটাকে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম।
ইদানিং ব্রাহ্মণবাড়িয়া বেশি যাওয়া হচ্ছে। শুধ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া না, দুই দিন পর পর কোথাও না কোথাও যাওয়া হচ্ছে৷ বেকার থাকার এই এক জ্বালা৷ শান্তিমতো ঘরে বসে থাকা যায় না৷ কোনো না কোনো কাজে প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও যাওয়া লাগে। এই যেমন গত পরশু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়েছিলাম। আজ আবারও। যদিও আজ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজেই গিয়েছিলাম৷ এবং যাওয়ার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত এতটাই ব্যাস্ত ছিলাম যে অন্য কোনো কাজে মনযোগ দিতেই পারি নি।
তাড়াহুড়ো করে সবকিছু শেষ করে আবার যখন ফিরতি পথে রওয়ানা দিই, ঘড়িতে তখন দুপুর প্রায় দুইটা। সকালের দিকে বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া কিছুটা ঠান্ডা থাকলেও দুপুরে ছিল বেজায় গরম। লোকাল ট্রেইন কর্নফুলি ছাড়া অন্য কোনো ট্রেইন ছিল না। এই ট্রেইনের নামটাও সুন্দর। চট্টগ্রামের কর্নফুলি নদীর নামে এই ট্রেইনের নামকরন করা হয়েছে।
যদিও কর্নফুলি নদীর নামের পেছনেও ছোট একটা ইতিহাস আছে। একসময় কর্নফুলি নদীর দুই পাড়ে জেলেদের বসবাস ছিল। এই দুই সম্প্রদায়ের জেলেদের মাঝে নিয়মিত বিয়ে শাদি হত। তো একবার বিয়ের পর নৌকা করে অপর পাড়ে যাওয়ার সময় নতুন বৌ এর কান থেকে স্বর্ণ কিংবা রোপার ফুল পানিতে পড়ে যায়। অনেক খুঁজাখুজি করেও সেই ফুলের হদিস পাওয়া যায় নি। সেই থেকেই এই নদীর নাম কর্নফুলি হয়ে গিয়েছিল। যদিও গল্লটা কতটুকু অথেন্টিক, আমি নিশ্চিত না৷ স্থানীয় লোকমুখে শোনা আরকি। কর্ণফুলি ট্রেইনটা যেহেতু ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে চলাচল করে, তাই এটির নাম কর্নফুলি রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের এই একটা জিনিস আমার খুব ভাল লাগে৷ ট্রেইনের নামগুলো খুব সুন্দর সুন্দর হয়। যেমন ময়মনসিংহে এক ট্রেইনের নাম এগারো সিন্দুর। নাম শুনে প্রথমে অবাক হলেও পরে জানলাম কিশোরগঞ্জের এক গ্রামের নাম নাকি এগারো সিন্দুর। সেই গ্রামের নামেই এই ট্রেইনের নামকরন করা হয়েছিল।
যায় হোক, কর্নফুলি ট্রেইনের নাম সুন্দর হলেও রূপ কিন্তু মোটেও সুন্দর না। যেহেতু লোকাল ট্রেইন, তাই প্রতি স্টেশনেই থামে, আর প্রচুর মানুষ। গন্তব্যস্থানে পৌছতেও সময় লাগে বেশি। যেহেতু অন্য কোনো লোকাল ট্রেইন নেই এই সময়ে, তাই যাত্রীর চাপও বেশি। একে তো গরম, তার উপর বদ্ধ পরিবেশ, মানুষও বেশি, তাই প্রচন্ড গরম। এই গরমেই প্রায় ২ ঘন্টার মতো ট্রেইনের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। এই রুটে অন্যান্য ট্রেইনগুলোতে কিন্তু এত সময় লাগে না। সর্বোচ্চ ৪৫-৫০ মিনিট। কিন্তু কর্নফুলি তো লোকাল ট্রেইন। এটার কথা আলাদা।
পুরো দুই ঘন্টা ট্রেইনের ভেতর দাঁড়িয়ে থেকে অবস্থা যখন কাহিল, তখন এসে পৌছাই কুমিল্লায়। ট্রেইন থেকে নেমে মনে হচ্ছিল স্বর্গে চলে এসেছি। কারণ কুমিল্লার আকাশ তখন মেঘলা হয়ে ছিল, সাথে বাতাস। পুরো শরীরটা মুহুর্তের মাঝেই জুড়িয়ে গিয়েছিল। হেঁটে হেঁটে পুরো স্টেশন পার হয়ে বাসায় এসেছিলাম। কারণ আবহাওয়াটা ভাল লাগছিল খুব। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আজ দুপুরে বেশ গরম পড়লেও কুমিল্লায় তা হয় নি। সারাদিনই আকাশটা মেঘলা ছিল। সে জন্যই মূলত এত ভাল লাগছিল।
সব মিলিয়ে খারাপ কাটে নি দিনটা। তবে ব্যাস্ততার কারণে দিন শেষে কিছুটা ক্লান্ত অনুভব করছিলাম। একটা সুন্দর ঘুমই পারে এই ক্লান্ত ভাবটা দূর করে দিতে...
কর্ণফুলি নদীর নামকরণের ঘটনাটা মজার ছিলো...
বৃষ্টি আসার আগে আকাশে মেঘ,সাথে ঠান্ডা বাসাত এই পরিবেশটা আসলেই স্বর্গীয় বলে মনে হয়।