অভয়নগর ভয়: টেরাকোটার খোঁজে
টেরাকোটা, মন্দির, যুগের-কালের সাক্ষী রেখে সুউচ্চ দাঁড়িয়ে থাকা ইমারত দর্শন আমার ভীষণ আগ্রহের।
মনে পড়ে, দিনাজপুরের দিকে যেবার গেলাম, কান্তজীর মন্দির দেখার জন্য কত কাহিনী। একদিন গেলাম বন্ধ, পরেরদিন গেলাম বন্ধের ঠিক আগে দিয়ে তাই ঢুকতে দিলনা, তারপর অবশেষে তৃতীয় ধাক্কায় সঠিক সময়ের ব্যাপার বুঝে যেতে পড়েছিলাম তাও একদম সন্ধ্যার ঠিক আগে মুহূর্তে। ভালোভাবে দেখা হয়নি।
১১-শিব-মন্দির দেখতে যেয়েও আমাদের সেরকমই ঝক্কি হলো। এমন না যে এটায় কান্তজী'র মন্দিরের মতো সাঁঝের বেলায় মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেবার ব্যাপার ছিল, তবে ঘোর গহীনে, প্রায় বনের মাঝে অন্ধকারে দেখবার কোনো সুযোগই থাকতোনা।
আমার ইচ্ছে ছিল, বিকেল বিকেল পৌঁছে, মন্দিরের মঠে বিকেল আর সন্ধ্যা ঘনানো দেখবো। কিন্তু সেদিন আমাদের ঘোরার শেষ দিন, অথচ বাকি ছিল কত কিছু, সে জন্য দিনের পরিকল্পনাটা একটু ঘটনাবহুল ছিল।
খুলনা থেকে বাগেরহাট একদিকে, আর অভয়নগর একদম সোজা উল্টো দিকে, যশোরের রাস্তায়।
চুই-ঝালের গরুর গোস্ত দিয়ে পেট টান করবার পর মনে হলো একটা ভাত ঘুম দেই কিন্তু সে সুযোগ নেই।
সবাইকে ঠেলেঠুলে নিয়ে আবার বসে চেপে বসলাম অভয়নগরের উদ্দেশ্যে।
ওখানে নেমে মন্দিরের কথা জিজ্ঞেস করলাম আশেপাশে কিন্তু খুব একটা তথ্য পাওয়া গেলোনা।
অটোরিক্সা চালকরা নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু ওদের আবছা ভাব ভঙ্গিতে না চেনার ভাবটা স্পষ্টই মনে হলো।
তবে এতটুকু আন্দাজ করা গেলো যে মন্দিরটি যেদিক দিয়েই যায়, নদী পেরিয়ে যেতে হবে।
এবার ঘাটের খোঁজে চললাম।
বাজারের বিভিন্ন লোককে জিজ্ঞেস করতে করতে এগিয়ে চললাম এবং অবশেষে ভৈরবের বুকে ঘাটের দেখা পেলাম।
আশংকা করছিলাম সন্ধ্যার আগে মন্দিরে পৌঁছাতে পারবো না। আবার নদী মাঝখানে পড়ায় নদীরে ওপর থেকে কতটুকু দূরত্ব তাও ঠাহর করা যাচ্ছিলো না।
আমাদের কথোপকথন শুনেই, এক রমণী এগিয়ে এলেন ব্যাপার জানতে। তাকে খুলে বলে সে এলো আমাদের উদ্ধার কর্ত্রী হিসাবে। বলল তিনিও ওদিকেই যাচ্ছেন। নদীর উপরে যেয়েই আমাদের ভ্যান ভাড়া করে যেতে হবে, বেশ খানিকটা ভেতরেই মন্দিরটি।
আমি অবশ্য জানতে পারলাম না যে আমার সঙ্গিনীরা এক অজপাড়াগাঁয়ে, ঠিকানাবিহীন, অচেনা-অজানা জায়গার এক ভাঙাচোরা মন্দির দেখবার এ উন্মাদনা কেন, তবে তেমন ভালো তাঁরা যে কেউ বিরূপ কোনো মন্তব্য করলেন না।
মেয়েটির নাম ছিল রিনি, ভারী মিশুক আর মিষ্টি। নৌকা ঘটে ভিড়তেই সে আমাদেরসহ ভাড়া দিয়ে তড়িঘড়ি নিয়ে একখানা ভ্যান ঠিক করে দিল এলাকার দিদিগিরি দেখিয়ে।
তাকেও নিয়ে নিলাম আমাদের সাথে।
চলতে চলতে গল্প হলো বেশ। সে জানালো, তার জরুরি কাজটা না হলে সে নিজেই আমাদের সাথে যেত। ফোন নম্বর দিয়ে দিল, পথিমধ্যে যেকোনো অসুবিধায় ফোন করবার জন্য।
তারপর ওর গন্তব্য এসে গেলে আমরা বিদায় নিলাম।
যদিও প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল, তবুও রিনির নম্বর থাকায় খুব একটা দুশ্চিন্তা হলোনা।
আমরা চলছিতো চলছিই।
গ্রামের আকাঁবাকাঁ মেঠো পথ, উঁচুনিচু ঢাল, ঝাঁকুনির চোটে হজম হয়ে যায় চুই-ঝালের গোস্ত।
অনেকটুকু যাবার পর গ্রাম ছেড়ে প্রায় বনের মধ্যে ঢুকে গেলাম।
একেতো বেলা ফুরিয়ে যাওয়া, তারউপর সুবিশাল বাঁশের ঝাড়ের মাঝে যেটুকু আলোর রেশ আকাশে আছে তা পৌঁছাতে না পারা, বেশ এক ভৌতিক আবহ দিলো। ভ্যানওয়ালা চাচা খুবই চমৎকার মানুষ রিনি থাকার সময় কথার আলাপে বুঝেছিলাম।
তাই এই প্রায় গহীন অরণ্যে, অচেনা বনে খুব একটা ভয় হলোনা। তবে মন খারাপ হলো এই ভেবে যে, যার জন্য এত ঝড় ঝামেলা করে আসা, সেই মন্দিরটিই হয়তো দিনের আলোয় দেখতে পাবনা।
গুগলের ছবি দেখে বুঝেছিলাম এই মন্দিরকে হেরিটেজ হিসাবে সংরক্ষণ করা হয় না যেহেতু, তাই আশেপাশে আলোর আয়োজন থাকবে আশা করা বৃথা।
তবে একেবারেই যে পরিত্যক্ত হবে, আশেপাশে এমনকি লোকালয়ও থাকবেনা এই আশা করিনি!
আবার এটাও জানিনে যে মন্দিরের খোঁজে যাচ্ছি সেটাই কিনা!
মনে হয় না, ইতিপূর্বে আমাদের মতো আবেদন নিয়ে আর কেউ এই শিব মন্দিরকে দেখতে এসেছে অতদূর থেকে।

এরকম নানান আশংকার দোলাচালের মাঝে অবশেষে আমরা সত্যিই খুঁজে পেলাম ১১-শিব মন্দির!
একেবারে গহীনের মাঝে, নিস্তব্ধতার প্রতিচ্ছবি হয়ে, কালের আঁচড়ে ক্ষয়ে যেয়েও এক অদ্বুত গাম্ভীর্যে দাঁড়িয়ে আছে ১১টি শিবের স্তম্ভ।

যখন মন্দিরের সদর দরজায় পা দিলাম তখন বেলা শেষের একেবারে ক্ষীণ আলোটুকুও বিদায় জানিয়ে আঁধারের ঝাঁপি খুলে দিল। তার মাঝেই খুব দ্রুত পটাপট কটা ছবি তুলে নিলাম।
চক্রাকারে ১১টি মন্দির গোল হয়ে একটা বৃত্ত তৈরি করেছে।
বৃত্তের ভেতরে ঢুকতেই হঠাৎ সন্ধ্যোগীতের আওয়াজ ভেসে এলো, ঠিক মাঝখানের মন্দিরটির ভেতর থেকে।

এগিয়ে যেতেই দেখলাম এক অবরোধ বিরহিণী কি ভীষণ আবেগ দিয়ে শিবের গীত গাইছেন সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে একমনে।
বিচ্ছিন্ন এই জনপদের মাঝে, গহীন অরণ্যের নিরালায়, আঁধারের মাঝে নিভু নিভু প্রদীপের আলোয়, বিরাগিণীর এই সেই সুরের বাঁধনে শিব মোহিত হলেন কিনা জানিনা কিন্তু মোহিত হয়ে রইলাম আমরা অনেকক্ষন।

কালের আঁচড়ে আহত সেই মন্দির, তবুও সাক্ষী শিরস্ত্রাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে শত অবহেলায়। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো ভীষণ। স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে, খাঁজে ভাঁজে লুকানো সে গল্পের গায়ে পরশ বুলাতে ইচ্ছে হলো খুব।
কিন্তু সময়াভাবে সেটা হলো না।
তবুও এই বিরান বিভুঁয়ে এই অভূতপূর্ব অর্চনা দেখাবার সৌভাগ্য হওয়ায় সে দুঃখ আর থাকলোনা।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় আর দাঁড়ালাম না আমরা। আবার দীর্ঘ রাস্তা যেতে হবে।
আমাদেরকে যিনি নিয়ে এলেন, চাচা যদিও আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে যাবার কথা ছিল, কিন্তু সে সহৃদয়বান যাননি। তিনিই আমাদের আবার ভৈরবের তীরে নিয়ে চললেন। এবার আমরা ফিরতি পথে না ফিরে, অন্য দিকে যে ঘাটের কথা শুরুতে শুনেছিলাম, সেদিকে চললাম।
ঝিঁঝিঁ পোকার সাথে আমরাও ভেসে ভেসে চললাম অন্ধকারের কোলে।
একসময় পথ হারালাম-কিনা এই আশংকায় দুলে দুলে পেয়ে গেলাম ছোট সংকীর্ণ ঘাটটি।
একটিই নৌকা বাঁধা ছিল ঘাটে, যেটাও পাত-তাড়ি গোটানোর আয়োজন করছিল।
একেবারে কানের গোড়া দিয়ে ঝামেলা কাটলো যাকে বলে।

অন্ধকার ভৈরবের বুকে স্নিগ্ধ বাতাসে, মৃদু ঢেউয়ের সাথে ভেসে ভেসে আমরা তিনটি প্রাণী অন্ধকারে নিজস্ব এডভেঞ্চারের ভাবনায় ডুবে-ভেসে এগিয়ে চললাম।
নৌকা থেকে নেমে মাঝিকে জিজ্ঞেস করে নিলাম মেইনরোডের হদিস।
আমরা নৌকা থেকে নেমে দুজন (আপাত দৃষ্টে মনে হওয়া) বখাটের সাথে মাঝির বাক-বিতন্ডা দেখে একটু দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম।
তাই নৌকা থেকে নেমেই আমরা জোর কদমে হাঁটা ধরলাম।
আশেপাশে আলোর অস্তিত্ব না থাকায় অন্ধকার তুলনামূলক যেন বেশীই চেপে বসেছিল প্রকৃতিতে। মোবাইলের টর্চ পাত্তাই পেলোনা সে নিকষ কালো আঁধারের বুকে।
যদিও মাঝি বলেছিল কয়েক মিনিট হাঁটলেই রাস্তায় উঠে যাব, কিন্তু অনেকক্ষন যাবৎ হাঁটার পরও যখন রাস্তা বা লোকালয় কোনোটারই দেখা পাচ্ছিলামনা, দুশ্চিন্তা হলো ভুল রাস্তায় হাঁটছি কিনা।
পাশের সংগিনীরা ভয় পাচ্ছে কিনা এই দুশ্চিন্তাও ছিল। তবুও এগিয়ে যেতে থাকলাম, এবং লোকালয়ের দেখা মিলল।
পরে একটা বাড়িতে যেয়ে নক করলাম। সাড়া মিললে, রাস্তার হদিস জানতে চাইলে জানালো ঠিক পথেই আছি। আর কিছুদূর গেলেই পেয়ে যাব।
তাই হলো। তারপর সেখান থেকে কোনমতে একটা বাসে ওঠে, ক্লান্তিতে দুলে দুলে খুলনা ফিরে আমাদের ঘটনাবহুল দিনের সাঙ্গ হলো।
দরজা খুলতেই মাসী বললেন, "বাবাহ সেই ভোরে বেরিয়েছ, দানা পানি কিছু পড়লো, না এভাবেই চলছে!"
আমি কাতর চেহারা করে বললাম, "এক কাপ চা হবে মাসীমণি।"
তিনি দ্বিগুন উৎফুল হয়ে বললেন, "হবে না মানে! হাতমুখ ধোও, আমি চা বানিয়ে আসছি।"